লেখক- (এন ইউ প্রিন্স) : | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১০:৪৮ অপরাহ্ণ
নাম তার হারেজ মাতুব্বর।
পূর্ব শ্যামপুর গ্রাম।
দরাজ দিল, আর বলিষ্ঠ কন্ঠস্বরের এক অনন্য উদাহরণ তিনি।
যার সুখ্যাতি রয়েছে দিগ্বিদিক।
এখনো যে বৃদ্ধ তাকে মনে রেখেছেন,
যে বয়োজ্যেষ্ঠ তাকে দেখেছেন,
তিনিও বলেন, “বড্ড ভালো লোক, কিন্তু জেদ ছিলো খুব।
যা বলেছেন তাই করেছেন।
তবে মনটা ছিলো উদার।
যারা এসেছেন তার তরে, নিয়েছেন ভরে।
সবসময়ে এক চিলতে হাসি লেপ্টে থাকতো মুখে।
কারো সাথে কখনো দ্বন্দে নয়, নয় কোন অন্যায়ে,
দেখি নি কোন প্রশ্রয়ে।
কুটিলতা, জটিলতা বা পরচর্চাও ছিলো না কোন।
তার মত দৃঢ়চেতা মানুষ কমই দেখা যায়।”
আজ,
ঘুমিয়ে আছেন তিনি,
দুচোখে আজ তার প্রশান্তির ঘুম।
সবুজ মাঠ আর হিমেল হাওয়া এখন তার নিত্যকার সঙ্গী।
যে ছিলো একসময়ের টগবগে যুবক,
যার ঠোটের মাঝে প্রকাশ পেত উদ্দাম হাসি,
কপালের ভাজে প্রস্ফুটিত হত অগ্নির বহ্নিশিখা,
যার কথায় মুগ্ধ হত মানুষ,
জমতো আসর!
আজ তিনি অনেক অনেক দূরে!
শায়িত আছেন গভীর ঘুমে।
এখন চাইলেই তাকে পাওয়া যায় না চায়ের আসরে
কিংবা আড্ডার মাঝে।
আপন আত্মীয়ও হয়েছে পর।
যাকে ছাড়া একসময়ে দিবস-রজনী হতো না পার
প্রকৃতির কি নিষ্ঠুরতা!
তাকে ছাড়াই সময় এখন স্বাভাবিক।
দিনশেষে সূর্য অস্ত যাচ্ছে, প্রারম্ভে তার উদয়
থেমে নেই জীবনের কাব্যধারা।
আজ এই কত বৎসর পর তার শিয়রের পাশে দাড়াতেই
হু হু করে কেঁদে উঠলো মন!
অবাক, বিস্ময় আর হাহাকারের গভীরতা টের পেলাম
হৃদয়ের মধ্যখানে।
একসময়ে কত দেখেছি যে উচ্ছ্বলতা,
যে প্রানবন্ত হাসি,
যার স্নেহ-ভালবাসায় আন্দোলিত হয়েছিলো এই মন,
কত চাওয়া পূরণ করেছেন যিনি,
কত চাহিদারও বুনন হোত যাকে দেখে,
তিনি আজ সকলকে ফেলে একাই জমিয়েছেন পাড়ি
দূর অজানার দেশে।
আজ কোন সাথী নেই, কোন আত্মীয় নেই
নেই তার পাশে চেনাজানা কেউ!
যাদেরকে ঘিরে ছিলো তার শত-সহস্র আয়োজন
তারাও পারে নি হতে তার অসীম যাত্রার সঙ্গী।
তার শিয়রের পাশে একটুখানি বসলাম।
হঠাত কোত্থেকে এক দমকা বাতাস বয়ে গেলো
আমার তনুমনে। মনে হলো যেন
প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে গেলো!
মধ্যদুপুরে ক্লান্ত এই পথিকের সকল ক্লান্তি দূরীভূত হলো মুহুর্তেই।
এখানের প্রকৃতি বড়ই শান্ত, ছায়াশীতল।
নিস্তব্ধতা আর শীতলতা যেন গ্রাস করেছে মুহুর্মুহু কোলাহলকে!
এক সময়ে যাকে ঘিরে জমেছিলো গল্পের আসর,
সারাক্ষণ যে ছিলো সকলের মধ্যমণি হয়ে,
কি নির্মম বাস্তবতা!
নিস্তব্ধ শান্ত পরিবেশে আজ ঘুমিয়ে রয়েছেন তিনি।
ঘুমিয়ে আছেন তারই পুরনো বন্ধুদের পাশে।
যারা তারও আগে ছেড়েছেন এই শহর, লোকালয়।
ব্যস্ততাকে বিদায় জানিয়েছেন চিরতরে।
আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী কিংবা দুরন্ত কিশোরেরও এখন নেই সামান্য চলাচল।
শুনশান নীরবতা, গম্ভীর পরিবেশ।
সামান্য পাতা পড়ার আওয়াজও কানে বাজে!
এক জোড়া টুনটুনি আর দূরের তালগাছের বাবুই
হয়েছে তার সঙ্গী।
ভোরে তাদের কিচিরমিচির আর অস্থির কোলাহলে
হয়ত মুখরিত হয় আমার পূর্বপুরুষ।
তার শিয়রের পাশেই আমার মাথাখানি রাখলাম,
কান পেতে রয়েছি সবুজ ঘাসের বুকে।
চেয়ে আছি অনন্ত আকাশ পানেতে
দেখলাম একটা বাবুই তার সরু চঞ্চুতে করে এক পালক খড় নিয়ে উড়ে যাচ্ছে,
উড়ে যাচ্ছে পাশের ওই তালগাছের দিকে।
তারই পিছু পিছু ছুটে গেলো আরেকটা বাবুই।
হয়ত বাসা বাধবে। জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হবে ওদের।
এভাবে একদিন ওদের চঞ্চলতাও মলিন হবে,
ওরাও আচ্ছন্ন হবে গভীর ঘুমে।
এটাই হয়তো জীবন!
ভাবছি,
এক সময়ে তাকে আর কেউ মনে রাখবে না,
আমার পূর্বপুরুষ আমারই প্রজন্মের কাছে হবে অচেনা!
এই শানবাঁধানো কবরে একদিন শ্যাওলা আর লতাগুল্ম জন্মাবে।
খোদাইকৃত অক্ষরে যে নাম লেখা আছে তা পুরনো হবে, চুন-সুড়কি খসে পড়বে।
শেষ স্মৃতিটুকুও মলিন হবে,
একদিন মহাকালের গহব্বরে সব বিস্মৃত হয়ে যাবে।
এক সময়ের দুরন্ত, ডানপিটে মানুষটি
যে দাপিয়ে বেড়িয়েছিলো সারা শহর,
যার খোজ রাখতো কত মানুষ!
সে যে ঘুমিয়ে আছেন নিভৃত কবরে একা,
কেউ তা আর জানবে না।
তার খোজ নিবে না।
হয়ত আমারই চলে যাওয়ার সাথে
শেষ হয়ে যাবে তার ইহলোকের সকল স্মৃতি!
যে তার হৃদয়ে ধারণ করতো তার সাথে ঘটে যাওয়া
প্রতিটি ঘটনা।
প্রকৃতি কত বিচিত্র!
এক সময়ে যে উত্তাল, অন্যতে সে শান্ত।
মানুষ কত অদ্ভুত!
সম্মুখে যে প্রিয়, একটু দূরেই সে বিস্মৃত।
অতি আপনের বিদায়েও সে কত স্বাভাবিক!
মানুষ ভুল করে ভুলে যায়,
ভুলে যাওয়াই মানুষের ধর্ম।
ভোলাতেই তার আনন্দ।
এই পৃথিবী ক্ষণিকের
এসেছিলাম একা, ফিরে যেতেও হবে একা।
শুধু রেখে যাওয়া কিছু স্মৃতি।
হয়ত আমার এই লেখা তুমি পড়ছো
আমারই পরবর্তী প্রজন্ম,
তাই তোমাকেই বলছি,
যাও পূর্ব শ্যামপুর, গিয়ে দেখে এসো তাকে।
কিভাবে ঘুমিয়ে আছেন তিনি!
ইচ্ছে হলে কান পেতে শুনো তার ঘুমের আওয়াজ
ভয় পেও না, সে তো তোমারই পূর্ব!
(২১ সেপ্টেম্বর ২০২০)
বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৮ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
shikkhasangbad24.com | hossain reaz
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | |
৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ |
১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ |
২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ |
২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |