অনলাইন ডেস্ক | ১০ নভেম্বর ২০২০ | ৯:২২ পূর্বাহ্ণ
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নেন বড় ঋণগ্রহীতারা। আর্থিক খাতের সিদ্ধান্ত নেন প্রভাবশালীরা। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণে যেসব ছাড় দেয় তাতে ফায়দা লোটেন তাঁরা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের আর্থিক খাত সম্পর্কে ঠিক এভাবেই মূল্যায়ন করেছে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি তাদের এক প্রতিবেদনে এসব ‘ব্যাংক লুটেরাদের’ নিষিদ্ধ করারও সুপারিশ করেছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যাংকিং খাতের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি।
সরকারের আমন্ত্রণে সুশান এম জর্জের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল চলতি জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সফর করে। প্রতিনিধিদলটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে। ছয় মাস ধরে পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের অর্থনীতি। তারপর গত মাসে অর্থনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে।
প্রকৃত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি : মহামারি করোনার কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়া হয়। ৯৪ হাজার ৩১০ কোটি থেকে প্রথম প্রান্তিকে (মার্চ প্রান্তিক) খেলাপি ঋণ কমে ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। তবে দ্বিতীয় প্রান্তিকেই তা বেড়েছে। জুন প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা বেড়ে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা বলে আসছেন, খেলাপি ঋণের তথ্যে কারসাজি করা হয়। তথ্য লুকানো হয়। আইএমএফও বলেছে, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ লুকানো হয়, কমিয়ে দেখানো হয়। প্রকৃত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি খেলাপি সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে। এই ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে ন্যুব্জ। এসব ব্যাংকের বর্তমান অবস্থার জন্য মালিক হিসেবে সরকার দায়ী বলে মনে করে আইএমএফ। তাই এসব ব্যাংকের মালিকানা ও তদারকির ক্ষমতা পৃথক করা এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত করার তাগিদ দিয়েছে তারা। তবে সংস্থাটি বলেছে, শুধু সরকারি নয়, পুরো ব্যাংকিং খাতের জন্য খেলাপি ঋণ বড় সমস্যা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করে আইএমএফ।
সমস্যার শিকড় প্রভাবশালীরা : আইএমএফ বলছে, ব্যাংকিং খাতে যেসব সমস্যা রয়েছে তার মূলে মূলত প্রভাবশালীরা। দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ করেন প্রভাবশালীরা। তাঁদের কাছে ব্যাংক খাতের বেশির ভাগ ঋণ। বড় বড় গ্রাহকরা বারবার খেলাপি ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা পান। উচ্চ আদালত থেকে খেলাপি ঋণে স্টে অর্ডার বা স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে। ঋণ কেলেঙ্কারির জন্য এঁরা দায়ী।
বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীন নয় : খেলাপি ঋণ বাড়াসহ এ খাতের দুর্বলতার প্রধান কারণ বিচক্ষণ তদারকির অভাব বলে চিহ্নিত করেছে আইএমএফ। সংস্থাটি মনে করে, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাত তদারকি, বিভিন্ন বিষয় অনুমোদন এবং হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বাধীন নয়। যখন দরকার বাংলাদেশ ব্যাংক তখন তার ক্ষমতা ব্যবহার করে না।
আইএমএফের সুপারিশ : আইএমএফ আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা পর্যালোচনাসংক্রান্ত প্রতিবেদনে সর্বমোট ৪৬টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে ২৯টি উচ্চ, ১১টি মধ্যম উচ্চ এবং ছয়টি মধ্যম পর্যায়ের সুপারিশ। সুপারিশের প্রথমেই সংস্থাটি বলেছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন বা সঞ্চিতি মওকুফ বা ধাপে ধাপে রাখার বিধান বাতিল করতে হবে। দুর্বল বা দেউলিয়া পথে যাওয়া ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিলুপ্ত করতে হবে বলে মনে আইএমএফ। এরপরই আইএমএফ প্রভাবশালীদের কথা বলেছে।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান খারাপের পেছনে দায়ী প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকে উচিত বিদ্যমান ক্ষমতা ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা। পাশাপাশি খেলাপিরা যাতে আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসতে না পারে সে জন্য আইন সংশোধন করতে হবে। বড় বড় গ্রুপের কাছে বেশি ঋণ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে অর্থনীতি ঝুঁকির মুখে পড়বে। ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে। এ জন্য ব্যাংক কম্পানি আইনসহ প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করতে হবে। আইএমএফ মনে করে, ৯০ দিনের বেশি পার হওয়া অনাদায়ী যেকোনো ঋণকেই খেলাপি বলে গণ্য করতে হবে। আন্তর্জাতিক এ রীতি মেনে চলা উচিত। পর্যাপ্ত লাইসেন্স প্রক্রিয়া এবং ঝুঁকিভিত্তিক তদারকি ব্যবস্থা না আসা পর্যন্ত নতুন ব্যাংক ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়া স্থগিত রাখা। ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। আইএমএফ বলেছে, ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের ঘাটতির জন্য পর্ষদে ২০ জন পরিচালকের সংখ্যা দায়ী। কারণ এর বিপরীতে মাত্র তিনজন স্বাধীন পরিচালক রয়েছে। তাই স্বাধীন পরিচালকের সংখ্যা আরো বাড়ানো উচিত।
প্রশংসার মধ্যেও আছে ‘কিন্তু’ : তবে সব বিষয়ে সমালোচনা করেনি আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি। দেশের অর্থনীতির প্রশংসা করেছে আইএমএফ। বলেছে, গত এক যুগ ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি খুবই সন্তোষজনক অবস্থায় আছে। তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর ভর করে সব সময় গড়ে ৬ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যে দেশটি একসময় কৃষিনির্ভর ছিল সে দেশের অর্থনীতি এখন উৎপাদননির্ভর। কিন্তু এ দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
যা বলছেন অর্থনীতিবিদরা : আইএমএফের প্রতিবেদনের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবং অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ী এসব সুবিধা পাচ্ছেন। আমাদের দেশে ব্যাংকের মালিক রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী। এতে ব্যাংকিং খাতের সুশাসন বিঘ্নিত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু ব্যবহার করার সময় তারা কতটুকু স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে পারছে, চাপের মুখে কতটুকু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, সেটা ভাববার বিষয়। সব মিলিয়ে ব্যাংকিং খাতে কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিদ্যমান। এখানে সরকারের সদিচ্ছা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃঢ়তার সমন্বয়ের প্রয়োজন। তা না হলে অর্থনীতিতে এটা অভিঘাত করবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের নির্বাহী পরিচালক এবং অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সমস্যাগুলো আমরা সবাই জানি। অনেক দিন ধরেই তা বলা হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। ভবিষ্যতেও কোনো কাজ হবে কি না তা জানি না। ব্যাংকিং খাত যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সে জন্য সরকারের উচিত দ্রুত বস্তুনির্ভর পরিবর্তন আনা। কারণ ঋণখেলাপিদের পুরস্কৃত করে ব্যাংক খাত বাঁচানো যাবে না। সরকার খেলাপি ঋণের ব্যাপারে তথ্য লুকাচ্ছে। প্রকৃত খেলাপি দ্বিগুণেরও বেশি। এসব সমস্যা ধামাচাপা বা জটিল না করে সমাধান করা উচিত।’
বাংলাদেশ সময়: ৯:২২ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১০ নভেম্বর ২০২০
shikkhasangbad24.com | hossain reaz
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ৬ | ৭ |
৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ |
১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ |
২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ |
২৯ | ৩০ |