• রবিবার ২৮শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

    শিরোনাম

    বিশ্ব কিংবদন্তি প্রয়াণের ১৯ বছর

    অনলাইন ডেস্ক | ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

    বিশ্ব কিংবদন্তি প্রয়াণের ১৯ বছর

    বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর আত্মার সম্পর্ক। কারণটিও হৃদয়ের পরম অনুভূতি মেশানো। সবচেয়ে বড় প্রয়োজনের সময় তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পাশে। এদেশের মানুষের চরম দুর্দিনে বাড়িয়েছিলেন সাহায্যের হাত।

    জগৎবিখ্যাত এই মানুষটি হলেন জর্জ হ্যারিসন। আজ ২৯ নভেম্বর ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী এই মহান শিল্পীর।বাংলাদেশের পক্ষে গোটা বিশ্বকে করেছিলেন জাগ্রত তিনি। গোটা দুনিয়ায় সাড়া জাগানো ‘দ্য বিটলস’ ব্যান্ড দলের লিড গিটারিস্ট এবং অন্যতম কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে।

    বিটলস ব্যান্ড ভেঙে যাওয়ার পরও তাঁর খ্যাতি এতটুকু কমেনি। সংগীতের আকাশে সবসময়ই নিজের দীপ্তি ছড়িয়েছেন। আপন মহিমায় হয়েছেন ভাস্বর। সংগীতশিল্পীর পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন গীতিকার, সংগীত ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।

    ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর নেওয়া একটি উদ্যোগই নাড়া দিয়েছিল পৃথিবীর মানুষকে। সবাইকে জানিয়েছিলেন পাক হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের ওপর কী নিপীড়ন আর হত্যাযজ্ঞই না চালাচ্ছে। তুলে ধরেছিলেন প্রতিবেশী ভারতে শরণার্থী হওয়া কোটি মানুষের দুঃসহ বেদনার কথা। আর সেটাও তিনি করেছিলেন গানে গানেই। পৃথিবীর বুকে আয়োজন করেছিলেন সম্ভবত প্রথম চ্যারিটি কনসার্ট। সেই কনসার্টের ব্যাপকতা এতটাই ছিল যে শত বছরের অন্যতম সেরা আয়োজনের তকমাও জুড়ে আছে সাথে।

    ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। দিনটি ছিল রবিবার। ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশংকের অনুরোধে একটি কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন ব্রিটিশ সংগীশিল্পী জর্জ হ্যারিসন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ঐতিহাসিক মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের ন্যয়সঙ্গত দাবিকে। কনসার্ট থেকে পাওয়া অর্থ ইউনিসেফের মাধ্যমে খরচ হয়েছিল বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য।

    কনসার্টটিতে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন নোবেল বিজয়ী বব ডিলানসহ পৃথিবী সেরা শিল্পীরা। কেবল তাই নয়, সেদিনের কনসার্টে জর্জ হ্যারিসনের লেখা, সুর করা ও গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। গানের শুরুটা ছিল ‘আমার বন্ধু এসেছিল…’। এই বন্ধু বলতে তিনি রবি শংকরকে বুঝিয়েছেন। পরে গানের প্রতিটি লাইনে তিনি অসাধারণ কথামালায় তুলে ধরেছেন নিপীড়িত মানুষের কথা। ছিল বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গভীর এক আবেদন।

    জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ’ গানটি ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস এর ‘দ্য রেকর্ড প্লাট’ নামের বিখ্যাত স্টুডিওতে ধারণ করা হয়েছিল। ওই মাসেরই ২৮ তারিখ অর্থ্যাৎ ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এর ঠিক তিন দিন আগে গানটি রিলিজ করা হয়। জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে এই গানটির সহ প্রযোজক ছিলেন আমেরিকান বিখ্যাত প্রযোজক, সংগীতশিল্পী ও গীতিকার হার্ভি ফিলিপ স্পেক্টর। যিনি মূলত ফিল স্পেক্টর নামে পরিচিত ছিলেন। আমেরিকান সংগীতশিল্পী লিয়ন রাসেল, সেক্সোফোন বাদক জিম হর্ন এবং ড্রামার জেমস লি কাল্টনার গানটি ধারণে সহায়তা করেন। আরো সহায়তা করেন ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী ও এক সময়ের দ্য বিটলস ব্যান্ডের ড্রামার রিঙ্গো স্টার।

    পৃথিবীর ইতিহাসে ‘বাংলাদেশ’ গানটিই ছিল প্রথম কোন চ্যারিটি সংগীত। গানটিকে বলা হয় ‘সংগীতের ইতিহাসের অন্যতম নিবিড় সামাজিক বক্তব্য’। ২০০৫ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান ‘বাংলাদেশ’ গানটি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘গানটির মধ্যে যে হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য উঠে এসেছে, তা বাংলাদেশের সংকট সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে মানুষকে স্পর্শ করেছে।’

    বিটলস ব্যান্ডের সঙ্গে জর্জ হ্যারিসনের বিচ্ছেদের পর এই একক গানটিই তাঁকে সাফল্যের শীর্ষতম জায়গায় নিয়ে যায়। যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে একনাগাড়ে গানটি দীর্ঘদিন ছিল শীর্ষ দেশে। সেইসঙ্গে আমেরিকার বিলবোর্ড হট হান্ড্রেড এ ২৩ নম্বরে ছিল।

    ভারতীয় সংগীত গুরু ও সেতারবাদক পণ্ডিত রবি শংকরের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল জর্জ হ্যারিসনের। ফলে দিনে দিনে ভারতীয় সংগীতের প্রতি প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। এমনকি রবি শংকরের কাছ থেকে সেতারের তালিম পর্যন্ত নিয়েছিলেন। গভীর বন্ধু থেকে রীতিমতো ভারতীয় এই পণ্ডিতের শিষ্য পর্যন্ত বনে যান তিনি। জীবনভর ছিল সেই বন্ধুত্ব। দুইজন একসঙ্গে অনেক কাজও করেছেন।

    বাংলাদেশের মহান বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের লিভারপুলে। সংগীত তাঁকে নিয়ে গেছে গোটা দুনিয়ায়। তবে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৬৬ সালে ব্রিটিশ মডেল ও ফটোগ্রাফার প্যাট্রিসিয়া অ্যান বয়েডকে বিয়ে করেন জর্জ হ্যারিসন। এরপর এক দশকেরও বেশি সময়ের দাম্পত্য জীবন শেষ হয় ১৯৭৭ সালে বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে।

    পরের বছর জর্জ হ্যারিসন আমেরিকান লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অলিভিয়া ত্রিনিদাদ হ্যারিসনকে বিয়ে করেন। ১৯৭৮ সালের ১ আগস্ট জন্ম হয় তাঁদের একমাত্র সন্তান ডানি হ্যারিসনের। মজার বিষয় তাঁদের সন্তান জন্মের তারিখটি ছিল দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর বর্ষপূর্তির দিন।

    জীবনের শেষ দিনগুলোয় রবি শংকরের সঙ্গে কিছু কাজ করছিলেন হ্যারিসন। তাঁর মধ্যে ছিল ‘শান্টস অব ইন্ডিয়া’ অ্যালবামটি। ভারতীয় ক্লাসিক্যাল ও আধ্যাত্মিক সংগীতের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে এটির প্রযোজকও ছিলেন তিনি। সেটির প্রচারণার জন্যে ১৯৯৭ সালে জর্জ হ্যারিসন সবশেষ টেলিভিশনে পর্দায় এসেছিলেন। এর পরই গলায় ক্যান্সার ধরা গড়ে তাঁর। তিনি রেডিওথেরাপি নিতে শুরু করেন।

    এরমধ্যে ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডে ফ্রাইয়ার পার্কে তাঁর বাড়িতে ঢুকে মানসিকভাবে অসুস্থ এক ব্যক্তি জর্জ হ্যারিসন ও তাঁর স্ত্রী অলিভিয়ার ওপর ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে। এতে হ্যারিসনের ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে একসময় তাঁর ফুসফুসে ক্যান্সারও ধরা পড়ে। অবশেষে ২০০১ সালের ২৯ নভেম্বর মাত্র ৫৮ বছর বয়ে মারা যান এই কিংবদন্তি।

    শেষ বিদায়টা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেই; ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসে। বেভারলি হিলস এর হেদার রোডে পল ম্যাককার্থির বাড়িতে মারা যান তিনি। জীবনে ভারতীয় সংগীত ও সংস্কৃতির প্রতি ভীষণভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। এ কারণে হিন্দু ধর্ম অনুসারে তাঁর দেহাবশেষ দাহ করা হয়। যার অংশবিশেষ পরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ভারতের গঙ্গা ও যমুনা নদীতে।

    জর্জ হ্যারিসন এত বড় একজন মানুষ ছিলেন, যাঁদের কোনো দেশ থাকে না। গোটা পৃথিবীটাই তাঁদের দেশ। যেখানে মানুষ, যেখানে মানবতা, সেখানেই তাঁর মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষ। সংগীতে দুনিয়া কাঁপিয়েছেন। পৃথিবী তাঁকে মনে রাখবে। কিন্তু গভীর ভালোবাসায় মানুষটিকে মনে রাখবে বাংলাদেশের মানুষ। তিনি যে আমাদের পরমাত্মীয়। বিদায়ের এই দিনে হৃদয়ের ভালোবাসা জর্জ হ্যারিসন।

    Facebook Comments Box

    বাংলাদেশ সময়: ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৯ নভেম্বর ২০২০

    shikkhasangbad24.com |

    advertisement

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    advertisement
    শনিরবিসোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্র
     
    ১০১১১২
    ১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
    ২০২১২২২৩২৪২৫২৬
    ২৭২৮২৯৩০৩১ 
    advertisement

    সম্পাদক ও প্রকাশক : জাকির হোসেন রিয়াজ

    সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: বাড়ি# ১, রোড# ৫, সেক্টর# ৬, উত্তরা, ঢাকা

    ©- 2023 shikkhasangbad24.com all right reserved