অনলাইন ডেস্ক | ১৮ নভেম্বর ২০২০ | ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ
বিলাসবহুল লঞ্চের বিশাল ছাদ, যার বিশালতা ফুটবল খেলার মাঠের সমান। লঞ্চের প্রবেশপথে বড় বড় বর্ণে লেখা ‘নদীপথে নিরাপদ যাত্রীসেবা’। সর্বাধুনিক ও বৃহত্তর লঞ্চগুলোতে এমন লেখা আপনার চোখ আটকাবে। ভেতরে আইসিইউর ব্যবস্থা, আছে লিফট আর গোটা লঞ্চে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, সঙ্গে আরো কত কী! একতলা, দোতলা পেরিয়ে তিন তলা। তারো ওপরে লঞ্চের ছাদ, ছাদের প্রবেশ পথে লোহার গ্রিল মোড়ানো কক্ষ। সেটি নৌ নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আনসারদের থাকার কক্ষ।
কক্ষের একটু ভেতরে গিয়ে দেখা মেলে অস্ত্রাগারের। কিন্তু সেখানে অস্ত্রের দেখা পাওয়া দুষ্কর। তবে অস্ত্রাগারে পাবেন লাঠি। আর আনসারের পরিবর্তে লঞ্চকর্মী। যাদের প্রশিক্ষণ ছাড়াই স্বল্পবেতনে নিরাপত্তাকর্মীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। লাঠি দেখিয়ে লঞ্চকর্মীরা যাত্রীদের নিরাপত্তার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এমভি সুন্দরবন লঞ্চের ছাদের যেখানে ছুরিকাঘাতে নিহত যুবকের লাশ মিলছে, তার পাশেই নৌ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের কক্ষ। সেই কক্ষটিও টাকার বিনিময়ে যাত্রীদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছিল। লঞ্চের এমন পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে নৌ নিরাপত্তার বালাই নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সার্ভের সময় আনসার সদস্যদের থাকার বিষয়টি লঞ্চ মালিকরা নিশ্চিত করছেন। কিন্তু বাস্তবে অপেশাদার কর্মীদের দিয়ে নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। তাই প্রায়ই লঞ্চে দুর্ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি সভায় লঞ্চযাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আনসার সদস্য নিয়োগ দিতে বলা হচ্ছে। কিন্তু মালিকপক্ষ অতিরিক্ত ব্যয়ের অজুহাতে আনসার নিয়োগ দিচ্ছে না। অথচ সার্ভেতে প্রতিটি লঞ্চে আনসারদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কক্ষ ও অস্ত্রাগার রয়েছে।
বরিশাল-ঢাকা নৌপথে চালাচলকারী ২৮টি বেসরকারি যাত্রীবাহী লঞ্চের প্রায় সবগুলোর একই চিত্র। অর্থাৎ আনসারের পরিবর্তে লঞ্চমালিকরা তাদের কর্মীদের দিয়ে নিরাপত্তার কাজটি চালিয়ে নিচ্ছেন। পোশাকী কর্মীরা শুধু লাঠি হাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে করছেন। ফলে নিরাপত্তাহীনতর মধ্য দিয়েই প্রতিদিন রাতে বরিশাল-ঢাকা রুটের ১৫০ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিচ্ছেন কয়েক হাজার যাত্রী। এ কারণেই যাত্রী লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন, আআর কেবিনের যাত্রীদের খুন হতে হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে সুন্দরবন-১১ লঞ্চের তিন তলার ছাদে ধোয়া নির্গমনের চিমনির আড়াল থেকে এক যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে গত শনিবার রাত ৯টার দিকে বরিশাল নদীবন্দর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া এমভি সুন্দরবন-১০ লঞ্চের এক নারী যাত্রী মাঝ নদীতে ঝাঁপ দেন। তিনি মা ও খালার সঙ্গে ওই লঞ্চে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। এসব ঘটনারও পরও চলাচলকারী যাত্রীবাহী লঞ্চের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না।
বিআইডাব্লিউটিএ নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগ বলছে, ঢাকা-বরিশাল নৌপথের লঞ্চগুলোর মধ্যে বিলাসবহুল এমভি সুরভি-৯ ও সুরভি-৭, এমভি পারাবত-১১ ও পারাবত-৯, কালাম খান, টিপু-৭, সুন্দরবন-১০ ও সুন্দরবন-৭ লঞ্চে আনসার সদস্য ছিলেন। তবে শুরু থেকেই অ্যাডভেঞ্চার লঞ্চে আনসার সদস্য নেই। আনসারদের বেতন বৃদ্ধির কারণে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর থেকে অপর লঞ্চগুলো আনসারশূন্য। লঞ্চ মালিকরা তাদের নিজস্ব কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
পরিপত্র জারির মাধ্যমে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করা হয়। সে অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্থায় নিয়োজিত আনসার সদস্যদের বর্ধিত বেতন-ভাতা কার্যকরের নির্দেশনা দেয়া হয়। সরকারি সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য লঞ্চ মালিকদের চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু ঢাকা-বরিশাল নৌপথের লঞ্চ মালিকরা বর্ধিত বেতন-ভাতা না দিয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে সদস্যদের বেতন বন্ধ করে দেন। ওই ঘটনার পর বকেয়া বেতন ও বর্ধিত মহার্ঘ্য ভাতা দিতে সব লঞ্চ কম্পানিকে পুনরায় চিঠি দেয়া হয়। লঞ্চ মালিকরা বকেয়া বেতন পরিশোধ করলেও পরবর্তিতে সব লঞ্চ থেকে আনসার সদস্যদের বাদ দেন।
বরিশাল সদর উপজেলা আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা মেরিনা আক্তার বলেন, এক সময় বেতন-ভাতা ছিল আনসার সদস্যদের আট হাজার। পাশাপাশি কম্পানি কমান্ডারের আট হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারিতে বেতন বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৫ হাজার ও ১৬ হাজার ৫০০ টাকা। বেতন বৃদ্ধির অজুহাত তুলে মালিকরা আনসার সদস্যদের লঞ্চ থেকে তুলে দেন। পাশাপাশি অদক্ষ জনবল দিয়ে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। যাদের কাছে নিরাপত্তার জন্য কোনো অস্ত্র নেই। তিনি আরো বলেন, লঞ্চে অস্ত্রধারী আনসার সদস্য থাকলে খুনের মতো ঘটনা হয়তো নাও ঘটতে পারতো।
বরিশাল নৌ পুলিশের ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, লঞ্চের মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, ছিনতাইকারীদের তৎপরতা এখনো রয়েছে। লঞ্চগুলো হাজার হাজার যাত্রী নিয়ে দীর্ঘ ১৫০ কিলোমিটার নৌপথ পাড়ি দেয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াই। তাছাড়া লঞ্চে প্রায়ই অঘটন ঘটছে। লঞ্চ থেকে যাত্রীর নদীতে ঝাঁপ দেয়া বা খুনের মতো ঘটনা ঘটছে। তাই যাত্রাপথে লঞ্চযাত্রীদের ঝুঁকি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
বরিশালের নৌ-বন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নৌ পরিবহন অধিদপ্তর সার্ভে রিপোর্ট দেয়। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই আমরা লঞ্চগুলোকে রুট পারমিট (টাইম) দিয়ে থাকি। তবে সেই সার্ভে রিপোর্টে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য লাইফবয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। এক সময় যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য অস্ত্রধারী আনসার সদস্যদের রাখা হতো। এখন মালিকরা নিজস্ব কর্মীবাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা দিচ্ছেন। পাশাপাশি নিরাপত্তার জন্য লঞ্চে ক্লোজসর্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তবে যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আনসার সদস্য রাখার বিষয়টি ভেবে দেখা উচিত।
সুন্দরবন নেভিগেশন কম্পানির পরিচালক শহীদুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ঈদের সময় যাত্রী পাওয়া যায়। অপর সময় ডেক ফাঁকা থাকে। তাছাড়া হঠাৎ করেই আনসাের বেতন প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। সেই কারণে আনসার সদস্যদের বাদ দিয়ে নিজস্ব প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। পাশাপাশি নিরাপত্তার জন্য লঞ্চে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তার পরেও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে। আমরা চেষ্টা করছি, দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনতে।
বাংলাদেশ সময়: ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ১৮ নভেম্বর ২০২০
shikkhasangbad24.com | hossain reaz
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ||||
৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ |
১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ |
১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ |
২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |