ড. মুহাম্মাদ মোহন মিয়া | ০৩ নভেম্বর ২০২০ | ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ
মহান আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় মানুষ পাঠিয়েছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে এ জন্য যে তারা আমারই ইবাদত করবে।’ (সুরা : জারিয়াত, আয়াত : ৫৬)
মানুষের ওপর আল্লাহ বেশ কতগুলো মানবিক ও আদর্শিক দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহ পাঠিয়েছেন অসংখ্য খাবার ও পানীয়। তবে এসব পেতে হলে মানুষকে বেছে নিতে হয় হালাল ও উত্তম জীবিকার পথ। ঈমানদার মানুষ মাত্রই হালাল রুজি উপার্জন করার কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হালাল জীবিকার সন্ধান করা ফরজ ইবাদতের পরই অপরিহার্য কর্তব্য।’ এর মানে মৌলিক ইবাদতের পরই রয়েছে হালাল জীবিকার জন্য কর্মপ্রচেষ্টার তাগিদ। মনে রাখতে হবে, হালাল উপার্জন ছাড়া মানুষের আর কোনো গত্যন্তর নেই। ইবাদত কবুলের অপরিহার্য শর্ত হলো হালাল উপার্জন করা। আর কোরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থায় জীবিকা নির্বাহ করলে উপার্জন হালাল হয়।
উপার্জনের নানা পথ : মহান আল্লাহর এই বিশাল পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা উপার্জনের বিভিন্ন পথ ও পন্থা অবলম্বন করে। কেউ বা চাকরিজীবী, কেউ ব্যবসায়ী। এই দুই উপায়ে মানুষের যেমন কর্মসংস্থান হয়, তেমনি মানুষের জীবিকা উপার্জনের উপায় হয়। তা ছাড়া মানুষ আরো অন্য যেসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আয়-রোজগার করে সেগুলোও কোনো না কোনোভাবে ব্যবসায়ের আদলে হয়ে থাকে।
উপার্জনের পাথেয় হিসেবে চাকরি : পৃথিবীর মানুষের একটি অংশ চাকরিজীবী। এদের আমরা মূলত দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। সরকারি চাকরিজীবী ও বেসরকারি চাকরিজীবী। উভয় ক্ষেত্রে জীবিকা হালাল হতে হলে বেশ কতগুলো বিষয় শরিয়াহসম্মত হতে হবে। প্রথমত, প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড ইসলামী নীতির মধ্যে আছে কি না। কোনো অবৈধ বা অনৈসলামিক বিষয় নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান কায়-কারবার করে কি না। সুদ বা জুলুমের অন্য কোনো বিষয়ের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক আছে কি না। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। জনগণের কল্যাণ ও সেবার কাজে জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবীর বেলায় বেতন হালাল হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তবে যিনি চাকরি করবেন, তাঁকে অবশ্যই সত্ভাবে, ঘুষ ও প্রতারণা ছাড়া তাঁর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। সততা ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে তাঁকে নিষ্ঠাবান হতে হবে। তা হলেই ওই ব্যক্তির উপার্জন বা বেতন হালাল হবে।
উপার্জনের পাথেয় হিসেবে ব্যবসা : ব্যবসার পরিধি অনেক বড়। দুনিয়ার বেশির ভাগ মানুষ নানা ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। দোকান-পাট, কল-কারখানায় উৎপাদনসহ ব্যবসার প্রকারের শেষ নেই। ব্যবসা পরিচালনায় ইসলামী নীতি মেনে চলার গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো ব্যবসায়ীর উপার্জন ততক্ষণ পর্যন্ত হালাল বা বৈধ হবে না, যতক্ষণ না তিনি কতগুলো মূলনীতি মেনে চলবেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) ব্যবসার মাধ্যমে হালাল জীবিকা অর্জনকে উৎসাহিত করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা বাণিজ্য করো। কেননা তোমাদের জীবিকা ১০ ভাগে বিভক্ত এবং এর ৯ ভাগই রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে।’
আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.) ব্যবসাকে উৎকৃষ্ট ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি ব্যবসায়ীদের মর্যাদাকে সমুন্নত করতে গিয়ে বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সৎ ব্যবসায়ীরা সিদ্দিক ও শহীদদের সঙ্গে উঠবেন।’
তবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে গিয়ে কতগুলো মৌলিক বিষয় মেনে না চললে এ থেকে উপার্জন কখনোই হালাল হবে না। সেগুলো হলো—
ব্যবসায় স্বচ্ছতা : একজন ব্যবসায়ী সৎ, নিষ্ঠাবান ও ওয়াদা পালনকারী। তিনি প্রতারণা, প্রবঞ্চনার ঊর্ধ্বে উঠে সত্ভাবে আয়-রোজগার করবেন এবং ব্যবসা পরিচালনার সব অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে মুক্ত থাকবেন। ইসলাম অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জনকে নিষিদ্ধ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
ব্যবসায় সততা : ইসলামে ব্যবসাকে হালাল করার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সততার নীতি অবলম্বন করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীকে অবশ্যই সৎ হতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হয়ে যাও।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১১৯)
মহানবী (সা) বলেন, ‘কোনো লেনদেনে যারা মিথ্যা বলবে এবং কিছু লুকাবে, তাদের লেনদেনের বরকত নিঃশেষ হয়ে যাবে।’
ব্যবসায় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা : ইসলামে অঙ্গীকার রক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। অঙ্গীকার রক্ষা একজন সৎ ব্যবসায়ীর অন্যতম কর্তব্য। মহান আল্লাহ সুরা মায়েদার ১ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ করবে।’ মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে না, দ্বিন-ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।’ (বুখারি)
হারাম ব্যবসা নিষিদ্ধ : এমন অনেক বস্তু আছে, যার ব্যবসা করাকে ইসলাম বৈধ মনে করে না। যেমন মৃত প্রাণীর ব্যবসা, শূকর বেচাকেনা, নেশাজাতীয় বস্তু, মূর্তি ইত্যাদি। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের সুরা মায়েদার ৯০ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার দেবী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর, ঘৃণ্য বস্তু শয়তানের কাজ।’
মজুদদারি : খাদ্যদ্রব্য মজুদ করা অথবা তা বাজার থেকে তুলে নিয়ে দাম বাড়ানো এবং অধিক মুনাফার প্রত্যাশ্য করাকে ইসলাম অবৈধ করেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং অনেক মানুষ দুর্গতির মধ্যে পতিত হয়। এ ধরনের কাজ মানুষের কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট এবং সে আল্লাহ তাআলার ওপর অসন্তুষ্ট।’
প্রতারণা ও প্রবঞ্চনা : এমন অনেক ব্যবসায়ী আছে, যারা বেশি মুনাফার আশায় অথবা তার খারাপ সম্পদ বিক্রির জন্য ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নেয়। ইসলাম প্রতারণা করে কোনো কিছু বিক্রি করাকে অবৈধ করেছে। মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো বেচাকেনা হবে, তখন প্রতারণা কোরো না।’ তিনি অন্যত্র বলেন, ‘যে প্রতারণা করে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। প্রতারণা ও কপটতা মানুষকে জাহান্নামে ধাবিত করে।’
ওজন ও মাপে কম দেওয়া : ব্যবসার লেনদেনে ওজন ও মাপে কম দেওয়া সম্পূর্ণভাবে অবৈধ। কোনো ভালো ব্যবসায়ী কখনো এ কাজ করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সুরা বনি ইসরাঈলের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘যারা মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং ওজন করবে সঠিক দাঁড়িপাল্লায়, এটাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্ট।’
বেচাকেনায় অতিরিক্ত শপথ করা : অসৎ ব্যবসায়ী তার খারাপ দ্রব্য বা পণ্যকে ভালো বোঝানোর জন্য শপথ কাটে। পণ্য বেশি পরিমাণ বিক্রির জন্য ক্রেতার কাছে তার জিনিসের উৎকৃষ্ট হওয়ার গুণগান করে। এ বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা বেচাকেনার সময় অতিরিক্ত শপথ করা থেকে বিরত হও।’
লেখক : কো-অর্ডিনেটর, ইসলামী ব্যাংকিং কনভারশন প্রজেক্ট, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেড
বাংলাদেশ সময়: ১১:০৬ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৩ নভেম্বর ২০২০
shikkhasangbad24.com | hossain reaz
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ||||
৪ | ৫ | ৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ |
১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ |
১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ |
২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |