• বুধবার ৩১শে মে, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ ১৭ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

    শিরোনাম

    ঘসেটি বেগম ও ইতিহাসের পুনর্পাঠ

    লেখক: মাতুব্বর তোফায়েল হোসেন | ০২ নভেম্বর ২০২০ | ১১:১১ অপরাহ্ণ

    ঘসেটি বেগম ও ইতিহাসের পুনর্পাঠ

    ইতিহাস থেকে জানা যায়, পলাশী যুদ্ধের কিছুদিন আগে ঘসেটি বেগম সাতদিন অবস্থান করেছিলো বিক্রমপুরস্থ রাজবল্লভের বাড়িতে। এর থেকে অনুমান করা হয়, ধনকুবের রাজবল্লভের সাথে ঘসেটির সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক নয়, আত্মিকও। রাজবল্লভ পলাশীর যুদ্ধের আগে থেকেই খাজনার টাকা তসরূফের দায়ে নবাবের চক্ষুশূল ছিলো। ইংরেজদের সাথে আঁতাত না করে তার পক্ষে বাঁচার কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু ঘসেটির আঁতাত করার পেছনে বড় কোনো কারন খুঁজে পাওয়া যায় না। যেহেতু তার নিজের কোনো সন্তান ছিলো না। উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বে সে সরাসরি কোনো পক্ষ নয়। তবুও ইতিহাসে তার বিশ্বাসঘাতকতার কথাটি বিশেষভাবে আলোচিত হয়। এক্ষেত্রে চতুর রাজবল্লভের ভূমিকা থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

    ঘসেটির মতো একজন রাজকন্যাকে নিজের হাতের পুতুল বানাতে পারা ছিলো রাজবল্লভের বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয়। পুরুষের মনোরঞ্জণ, পুরুষকে কুপোকাত করার মোক্ষম অস্ত্র হলো ভ্রষ্ট নারী। বিধবা হবার কল্যাণে ঘসেটির পক্ষে বেহিসেবী জীবন যাপন সম্ভবপর হয়েছিলো মনে করা যায়। আর সুচতুর রাজবল্লভ কৌশলে ঘসেটিকে আয়ত্ত করে ফেলেছিলো। দুষ্ট রাজবল্লভের ছলচাতুরির অনেকগুলো উপায়ের মধ্যে একটি ছিলো ঘসেটি নামক অস্ত্র। অবস্থা এমন ছিলো যে, রাজবল্লভ ইঙ্গিত করলে ঘসেটি কারো বিছানায় যেতেও রাজি থাকতো।

    অপরদিকে ঘসেটি বেগমের মূল শক্তি ছিলো রাজবল্লভ। বলা যায়, রাজবল্লভের বাতাসে উড়ছিলো ঘসেটি বেগম। দুরাচারের কোনো জাত-বংশ থাকে না। ঘসেটি নিজের রক্তের সাথে বেঈমানী করতে পেরেছিলো রাজবল্লভের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়েই– এটা খুব সহজে অনুমান করা যায়। এই অনুমানের বাইরে ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে তার একাত্মতা আমাদের কাছে চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকে।

    ইতিহাসে প্রায়ই দেখা যায়, বড় কোনো রাজনৈতিক উত্থান-পতনে মোহগ্রস্ত নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। পুরুষের হাতের ক্রীড়নক হয়ে দুঃসাহসী সব অপকর্ম করতে পারে মোহগ্রস্ত নারীরা। মোহগ্রস্ততা থেকে নারী বিপদজনকভাবে ভ্রষ্ট হয়। পুরুষ তার আপন কলঙ্কের বোঝা নারীর উপর চাপিয়ে দেয়। বুদ্ধিবিভ্রমের শিকার হয়ে ভ্রষ্ট নারী, পুরুষের অঙ্গুলি হেলনের দাস হয়ে যায়। বিনা প্রতিবাদে নারী তখন ফরমায়েশ মতো অপকর্ম করতে রাজি থাকে। সবদিক বিবেচনা করে এই কথা বলাই যায় যে, পলাশীর যুদ্ধে ঘসেটি বেগম পরিপূর্ণভাবে রাজবল্লভের সেবাদাসের ভূমিকা পালন করেছিলো।

    সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর মীর জাফর ঘসেটি বেগমকে ঢাকার জিনজিরা প্রাসাদে অন্তরীণ করে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মীর জাফর তার ষড়যন্ত্রের দোসরকেই কারাগারে অন্তরীণ করে ফেলে। ওদিকে ঘসেটিকে বিপদজনক শত্রু মনে করে মীর জাফরের পুত্র মীরন তাকে ১৭৬০ সালে মুর্শিদাবাদ ফেরত নিয়ে আসার আদেশ দেয়। ঘসেটিকে নেয়া হচ্ছিলো নদীপথে। কথিত আছে, মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী নদীর ত্রিমোহনায় তার নৌকাকে ডুবিয়ে দেয়া হয় এবং তাতেই তার সলিল সমাধি ঘটে। একজন আপাত নিরীহ নারী শেষ পর্যন্ত পাপিষ্ঠ পুরুষের লোভ-লালসার বলী হয়ে জলাঞ্জলি গেলো। ইতিহাসের প্রচলিত পাঠ থেকে এই সত্যের কাছাকাছি পৌছুনো মুশকিল। প্রচলিত পাঠ হলো, বাবা আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পরে, ঘসেটি বেগম তার দ্বিতীয় বোন মায়মুনা বেগমের পুত্র শওকত জংকে সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সিরাজউদ্দৌলা বাংলার ক্ষমতায় আরোহণ করতে সমর্থ হয়। অবশেষে, ঘসেটি সেনাপতি মীর জাফর, ব্যবসায়ী জগৎ শেঠ এবং উর্মিচাঁদের সঙ্গে গোপনে ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের চার বছর আগে স্বামী হারানো ঘসেটির ব্যাপারে এই যুক্তি খুবই দুর্বল মনে হয়। তার কাছে তো কোনো বোনের পুত্রই কম আপন নয়। কোনো বোনের সাথে সুসম্পর্ক, কোনো বোনের সাথে খারাপ সম্পর্ক থাকতে পারে। কিন্তু বোনদের মধ্যে সেটা সাময়িকই হবার কথা। তার জন্য মরণঘাতী তৎপরতায় লিপ্ত হবার যুক্তি দুর্বল।

    আরেকটি মত প্রচলিত আছে, সিরাজ একদা ঘসেটি বেগমের প্রেমিককে হত্যা করেছিলো। সৈন্যদলের মধ্যে ঘসেটির গোপন প্রেমিক ছিলো। সিরাজ তাকে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছিলো। মৃত প্রেমিকের প্রতি ভালোবাসার টানে ভাগনের সাম্রাজ্য ধ্বসিয়ে দিয়ে নিজের জীবনকেই বিপন্ন করার মতলব একজন নারীর হবে– এই মতও মেনে নেয়া কঠিন। একমাত্র রাজবল্লভের সাথে তার গোপন সম্পর্কই বিপুল এই প্রমাদের যথাযথ কারন হতে পারে। নষ্ট-ভ্রষ্ট-জঘণ্য পুরুষের পাল্লায় পড়ে ঘসেটি বেগম তার আত্মপরিচয় ভুলে গিয়ে ঘৃণ্য খেলায় মেতে উঠেছিলো। হাজার বছর ধরে নারী কর্তৃক অবিশ্বাস্য সব বিপর্যয় ঘটানোর পরম্পরা বুঝতে হলে ঘসেটি বেগমের এই গোপন পাঠ উন্মোচন করার প্রয়োজন রয়েছে আমাদের। দুষ্ট রাজবল্লভের বিষবাষ্পে বিষাক্ত হয়েছিলো ঘসেটি বেগম। সেই বিষে নীল হয়েছিলো বিদ্রোহী বাংলা।

    বাংলায় কোনোদিন মীরজাফরের আকাল পড়েনি, ঘসেটি বেগমেরও আকাল পড়েনি কোনো কালে।

    Facebook Comments Box

    বাংলাদেশ সময়: ১১:১১ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০২ নভেম্বর ২০২০

    shikkhasangbad24.com |

    advertisement

    এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

    advertisement
    শনিরবিসোমমঙ্গলবুধবৃহশুক্র
     
    ১০১১১২
    ১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
    ২০২১২২২৩২৪২৫২৬
    ২৭২৮২৯৩০৩১ 
    advertisement

    সম্পাদক ও প্রকাশক : জাকির হোসেন রিয়াজ

    সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: বাড়ি# ১, রোড# ৫, সেক্টর# ৬, উত্তরা, ঢাকা

    ©- 2023 shikkhasangbad24.com all right reserved