লেখক: মাসুদ হাওলাদার | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১২:১২ অপরাহ্ণ
দুর্গাপূজার উপচার সংগ্রহ করার আরেকটি ঘটনা আমাকে শুধু পিছু টানে। গত ২ শতাব্দী পেরিয়ে এসেও কথাগুলো বুকের ভিতর তরতর করছে। তাই আজ আমি সেই ঘটনাটাই তোমাদের শোনাতে চাই । তখন ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি সময়। সামনে আশ্বিনে শুল্কাপক্ষে দুর্গাপূজা হবে। রাজেন্দ্র চন্দ্র রায় বাহাদুর ও দেবেন্দ্র চন্দ্র রায় বাহাদুর পাশাপাশি দুই মন্দিরে দুই ভাই আলাদাভাবে পুজা পালন করতেন। পূজা-অর্চনা অনুষ্ঠান আয়োজনে তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে সবসময় বেশ প্রতিযোগিতা লেগেই থাকতো।
তখন পুজার অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাড়ির চৌহদ্দি সীমানা জুড়ে মশাল জ্বালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হতো। পূজামণ্ডপের সামনে অস্থায়ী মঞ্চ করাও হতো। হ্যাজাক, ডে-লাইটের উচ্চ আলোয় এবং শো শো শব্দে পুরো মহল মাতিয়ে রাখতো। জমিদারের দুই ভাইয়ের মধ্যে রাজেন্দ্র বাবু একটু বেশিই শৌখিন গোছের লোক ছিলেন। আশ্বিনে পূজা উপলক্ষে কয়েকজন পাইক পেয়াদাসহ বাড়ির অন্যতম কর্মচারী সুবিন চন্দ্রকে পূজার উপচার সংগ্রহ এবং ভাণ্ডারী যাত্রাপালা বায়না করার জন্য কলকাতায় পাঠানোর আয়োজন করেন। সুবিন চন্দ্র তাঁর সঙ্গী সাথীদের নিয়ে বাইশরশি থেকে টমটম যোগে সোজা ভূবনেশ্বর নদীর সাইর বন্দরে আসেন।
সেখানে থেকেই জমিদার বাড়ির অন্যতম জলযান বজরা ও ঘাসি যোগে কলকাতা সোনাগাছির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আবহাওয়া অনুকূলে না হওয়া প্রায় ২ দিন পর বরিশালের কালিয়া হাটে নোঙ্গর ফেলে। কালিয়া হাটে ১ দিন বিশ্রাম শেষে মোট ৫ দিনের মাথায় সোনাগাছি পৌছায়। সুবিন চন্দ্র সোনাগাছির হাটে গিয়ে দেখতে পায় একটি চিনামাটির বিড়ালকে ঘিরে শত শত লোক জটলা বেধেছে। উদ্দেশ্য ইংরেজ এক কর্মকর্তা তাঁর শখের একটি চিনামাটির বিড়াল নিলামে বিক্রি করবেন। চিনামাটির বিড়ালটি তিনি বছর পাঁচেক আগে ইংল্যান্ড থেকে এনেছিলেন যার মূল্য ছিলো ৬ রৌপ্য মুদ্রা। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি তাঁর দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে যাবেন আর এজন্যই তিনি জিনিসটা বিক্রয় করতে হাটে এসেছেন। কলকাতার একজন নামকরা জমিদার সহ প্রশাসনের অনেক কর্তাব্যক্তিরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সুবিন চন্দ্র বিড়ালটি ৫ রৌপ্য মুদ্রা থেকে শুরু করে অবশেষে ১৪ শত রৌপ্য মুদ্রায় নিলামে দাম হাকান। এরপর কলকাতার জমিদার সহ সুবিনের কাছে সবাই বশ্যতা স্বীকার করেন।
সুবিন ১৪ শত রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে বিড়ালটি নিয়ে নিদারুন চিন্তার সাগরে ডুবুডুবু অবস্থায় বজরায় ফিরে আসেন! এতে সঙ্গী সাথীরাও অনেক চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ে। এখন কি হবে? রাজেন্দ্র বাবুর দেওয়া ১৫ শত রৌপ্য মুদ্রার অবশেষ মাত্র ১ শত মুদ্রা হাতে আছে। পূজা উপচার ভাণ্ডারী যাত্রাপালার অগ্রিম বায়না আরও কতো কি এসব কেমন করে সম্পাদন করা হবে? এ প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। নানান বিষণ্ণতায় সবাই আহার নিদ্রাবিহীন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে পুরো কলকাতা জুড়ে বাইশরশি জমিদার রাজেন্দ্র বাবুর কর্মচারীর চিনামাটির বিড়াল নিলামে কেনার কথা সবার মুখে মুখে মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। আর এ ঘটনা অল্প দিনের মধ্যেই বাইশরশি জমিদার বাড়িতেও পৌঁছে যায়। অনেক চিন্তাভাবনার পর সুবিন সঙ্গীদের নিয়ে তার ২ দিন পর বাইশরশির অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। নৌকা মাঝ নদীতে এসে নোঙর করা হলো। আবার নতুন করে চিন্তায় পড়ে গেলেন। মনের মধ্যে নানান প্রশ্নের উদ্বেগ সঞ্চার হলো। এখন সিন্ধান্ত নিবেন কি তাও ভাবতে পারছেন না।
একবার ভাবেন কলকাতা ফিরে যাই আবার ভাবেন বাইশরশি চলে যাই। এরপর সঙ্গীদের মধ্যে একজন বললেন, “আমরা যদি এখন কলকাতা ফিরে যাই তাহলে আমাদের কোন লাভ হবেনা! এতো মুদ্রা কিছুতেই আমরা সংগ্রহ করতে পারবোনা। এরচেয়ে রাজেন্দ্র বাবুর কাছে ফিরে যাওয়াটাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে। কেননা এমনও হতে পারে জমিদার বাবু আমাদের অন্যায় মওকুফ করে পুনরায় রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে কলকাতা পাঠাতে পারেন। যাহোক এবার সুবিন চন্দ্র বুকের ভিতর কিছুটা সাহস সঞ্চার করে সোজা বাইশরশির উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে লাগলেন। বজরা যথারীতি ৪ দিনে এসে পৌছালো সাইর বন্দরে। সুবিন বজরার জানালায় উকি দিয়ে দেখতে পেলেন রাজেন্দ্র বাবুর পাইক-বরকন্দাজ ও শত শত প্রজারা দাঁড়িয়ে আছে। বজরা হতে নামতেই পাইক পেয়াদাদের কোন একজন বললেন, ” জমিদার বাবু তোমাকে সোজা তাঁর খাসকামরায় গিয়ে সাক্ষাৎ করতে বলেছেন।” সুবিন ও তাঁর দলের সবাই আরও বেশি চিন্তা ও ভয়ের মধ্যে পড়ে গেলো। এরপর তিনি টমটম যোগে সরাসরি জমিদার বাড়ির সামনে এসে নামলেন। এরপর জমিদার বাবুকে দেখলেন তিনি বেশ অস্থিরতার মধ্যে পায়চারি করছেন। সুবিন জমিদার বাবুর চোখে চোখ পড়তেই সিংহের মতো গর্জন করে বললেন, “সুবিন তুমি যদি নিলামে হেরে যেতে তাহলে আমি তোমাকে চাকুরিতে রাখতামনা। তুমি আমার মানসম্মান উজ্জ্বল করেছো। তোমার মতো লোকেরই আমার অনেক বেশি প্রয়োজন ছিলো। কই দেখিতো কি এনেছো?” সুবিন মেরুন মকমলে মোড়ানো চিনামাটির বিড়ালটি রাজেন্দ্র বাবুর হাতে তুলে দিলেন। বিড়ালটি তাঁর হাতের মুঠোয় পেয়ে জমিদার বাবু সে কি যে খুশি হয়েছিলেন তা আর বোঝানো সম্ভব নয়।
এরপর জমিদার রাজেন্দ্র বাবু সুবিনকে ৫ শত রৌপ্য মুদ্রা উপহার দিলেন। আর সুবিনকে নিয়ে সবাই গর্ব করতে লাগলো।
আস্তেধীরে সুবিন চন্দ্র ও তাঁর সতীর্থগণদের পিছনে অসংখ্য পাইক-প্রজাদের ঢল নামতে শুরু করলো! বাড়িতে আজ অনেক লোকের সমাগম। সবাই আজ সুবিনকে দেখতে ও অভ্যর্থনা জানাতে এসেছে। রাজেন্দ্র বাবু সবার সামনে সুবিনের অনেক তারিফও করলেন। তার সামান্য কিছুদিন পর সুবিনকে আবার প্রচুর স্বর্ণ, রৌপ্য মুদ্রা এবং সঙ্গীদের দিয়ে কলকাতা প্রেরণ করলেন! কলকাতা সোনাগাছির হাটের পূজার উন্নত উপচার ও ভাণ্ডারী অপেরার অন্যতম নায়ক কালি কিংকর ঘোষকে সবার আগে চাই-ই চাই!
চলবে——-
(পাঠকগণের আগ্রহের উপর নির্ভর করবে)
বাংলাদেশ সময়: ১২:১২ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০
shikkhasangbad24.com | hossain reaz
শনি | রবি | সোম | মঙ্গল | বুধ | বৃহ | শুক্র |
---|---|---|---|---|---|---|
১ | ২ | ৩ | ৪ | ৫ | ||
৬ | ৭ | ৮ | ৯ | ১০ | ১১ | ১২ |
১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ |
২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ |
২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ |